Rose Good Luck পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২৬) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০২:১২:০৯ দুপুর

ছোট খালাসহ খালার স্কুলে উনার দুই সহকর্মীর এম পি ও ভুক্তির ব্যাপারে বেশ সমস্যা হয়েছিল। ঘুষের টাকার পরিমাণ নিয়ে দরাদরিতে স্কুলের সাথে ওই কাজের দায়িত্ব যাদের ছিল তাদের বনিবনা হচ্ছিল না। খালু সেটা কোনভাবে জানতে পেরে নিজের লোক দিয়ে ম্যানেজ করেন খালার অজান্তেই। তার ক্ষমতার এটা একটা সদ্ব্যবহার ছিল সন্দেহ নেই। খালা ব্যাপারটা জেনে একেবারে রেগে যান। তিনি আমাকে ধরে নিয়ে খালুর আফিসে গিয়ে হাজির হন। ঝগড়া করার জন্য!

আমরা গিয়ে বসে রইলাম। খালুর আসতে ঘন্টা দেড়েক লাগল। আমি একটু উসখুস করছিলাম। ছোট খালার ধৈর্য ফুরায় না। ঝগড়ার জন্য যদি এত করা যায়, ভালোবাসার জন্য কত করা যায় ভাবলাম। মনে মনে হাসলাম। ব্যাপারটা বুঝে আমার ও কিছু ধৈর্য বাড়ল বটে।

খালু রুমে ঢুকার সময় তার চেহারায় যে অনিশ্চিত ভাবটা ছিল আমার দিকে চোখ পড়তেই তা প্রশ্নবোধক চিহ্নে পরিণত হতে যাচ্ছিল- ছোট খালাকে দেখেই তা নিখাদ বিস্ময় এবং প্রায় সাথে সাথেই অনুরাগে রূপ নিল। আমি একটু আড়ষ্ট বোধ করলাম।

এক জোড়া ডিভোর্সি দম্পতি। নিজেদের অগোচরে ভালোবাসা যে অদৃশ্য হয়ে তাদেরকে অনুসরণ করে চলেছে- দুজনের অনুভুতিই মনে হল সেটা টের পেল। উপলব্ধি করলাম, তাহলে সম্পর্কের দৃশ্যমান অবয়ব যতই শেষ বা ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, এরকম আইনের এক আনুষ্ঠানিকতাকে দেখাক না, আসলে একটা নিবিড় সম্পর্ক সব সময় থেকেই যায়! অনুভুতি যাদের প্রবল তারা সেটা উপলব্ধি করেন। বুঝলাম, খালা খালু দুজনেই এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । বুঝলাম না -কেন তাহলে সংসারটা করা গেল না!

আমার ভাবনার কোন ফাঁকে দু'জনের মাঝে কথা শুরু হয়েছিল খেয়াল করিনি। যখন খেয়াল করলাম ততক্ষণে ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। সত্যিই তারা রাগারাগি করছেন দেখে আমি অনুমতি নিয়ে বাইরে চলে এলাম। ছোট খালা দশ মিনিটের মাথায় ঝড়ের গতিতে বের হয়ে এলেন।

যাকে দেখার জন্য এতটা সময় খরচ করলেন তাকে দশ মিনিটের বেশি দেখা সম্ভব হল না!

ক্ষয় ক্ষতিকে মেনে নিয়েই আমাদের বাসায় জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে। বাদলের জন্য ঘরে পড়ে স্কুলে পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা হল। স্কুলের একজন শিক্ষক ওকে ঘরে এসে পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন। একটু খরচ বাড়ল, কিন্তু আশা ফিরল,খুশি ফিরল। অভিভুত হলাম। বাবা-মায়ের ভিতরে মিল হয়েছে দেখে আমার মনে একটা ভাবনা এল। এক বারের সামান্য এই চেষ্টায় ঘরের দুটি পিলারের ভিতরে একটা সাম্যাবস্থাকে এনে দিতে পারলে, কেন দেশের নয় ? নিজের ভিতরে একটা আশ্বাসবোধ টের পেলাম। পার্টিতে যে বিশেষ উদ্দেশ্যে ঢুকেছিলাম সেগুলোকে ছাপিয়ে আরো শুভ আরো মহৎ একটা অনুভব হৃদয়ে ধীরে ধীরে জন্ম নিতে লাগল।

বাবা-মাকে নিয়েইতো পরিবার... এরপর দেশ... মানুষ.. পৃথিবী! মোটকথা নীতিগতভাবে একটা আনন্দময় সমাজব্যবস্থাকে আনার জন্য আমিও নিজেকে দেখে মনে করলাম,' হ্যা, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি যদিও একটি ক্ষুদ্র ইউনিট, তবুও কিছু একটা শুভ ইচ্ছা বাতাসে ছড়িয়ে যেতে পারব নিশ্চয় । যা অবশ্যই প্রভাব ফেলবে।

বাস্তবে কিন্তু সব খুব সহজ হল না। এসে যা দেখলাম, আমার আশাকে অনেক সংকুচিত করে ফেলল। অভয়নগরে একটা ঘটনা আমার মন ভেংগে দিল। এখনো মনে পড়লে শরীর অবশ হয়ে আসে। পেপারে ঘটনার খবর শোনা আর বাস্তবে ঘটনা দেখার কতটা পার্থক্য -জীবনের অসহনীয় কিছু মূহুর্তের অভিজ্ঞতা দিয়ে তা উপলব্ধি করলাম।

টিকে থাকার লড়াইটা আসলে ভয়ংকর!

সময় বয়ে যাচ্ছিল। আমি দলের কর্মকান্ডে নতুন উদ্যম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।একদিন যশোহরের এক এলাকায় গেলাম ভাইদের সহ। এক কর্মীর বিয়ের অনুষ্ঠানে। তার বোনের বিয়ে ছিল। খুবই একনিষ্ঠ কর্মী সে। এজন্য ওর অনুরোধ ভাইরা ফেলতে পারে নি। বিয়ের অনুষ্ঠানে সাদেক ভাই ও জাভেদ ভাই দুই মহারথীও ছিলেন,। এজন্য আলাদা নিরাপত্তাসহ দলীয় ক্যাডাররাও (সামরিক শাখার সদস্যরা) সামিল ছিল। খুবই জমজমাট সে বহর। ২০টি মটর সাইকেলে প্রায় ত্রিশের অধিক। নিজেকে কেমন গোপন শক্তির দাপটে আত্মম্ভর এক যুবরাজ মনে হচ্ছিল।

মিথিলা বাবু!

একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলা দরকার। তখন যদিও পুলিশ প্রশাসনের সাথে গোপন দলের কর্মীদের সম্পর্ক সাপে-নেউলে ছিল। তারপরও গোপন দলগুলোর নেতারা যখন 'বাহিনী টানতে' কিংবা ডেরা ছেড়ে দৃশ্যমান হতেন, তারা একত্রে চলাফেরা করতেন একবারে ক্ষমতায় টইটম্বুর হয়ে। অবশ্য এর পিছনে পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নুয়ে পড়া নেতৃত্ব নিয়ামক ভূমিকা পালন করত তাই। পথে পুলিশের দেখা হলেও তারাও পারতপক্ষে গোপন দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পেত না।

সাহস!

হ্যা বাবু, ওটা সাহসের ব্যাপারই ছিল রক্তাক্ত জনপদের ঐ দিনগুলোতে। যদিও বা থ্রি নট থ্রি রাইফেলধারী আর অফিসারদের কাছে পুলিশ স্পেশাল নিয়ে পুলিশ বাহিনী দলগুলোর প্রশিক্ষিত ক্যাডারদের এ,কে ফর্টিসেভেন বা এ,কে, টুয়েন্টি টু, শটগান যা বাঘ মারার থ্রি পিস বা ওয়ান পিস কার্টুজ সহযোগে লোডেড থাকত, সামনে পড়লে ক্যাডারদের উদ্ধত জবাব, " ফাইট না সাইড?" এর জবাবে বেশীরভাগই প্রশাসনের উত্তর হত 'সাইড!'

এমনই ছিল দিনগুলো! ক্ষমতার দম্ভে আত্মবিস্মৃত এক দলের সাথে বহমান সেই দিনগুলো।

বিয়ের অনুষ্ঠানে একেবারে শেষের যায়গায় একটা গোল বাঁধল। ঐ এলাকায়ও কয়েকটি গোপন দলের বিচ্ছিন্ন অবয়ব ছিল। তবে ভাইরা যদিও ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সেনাপতি, তাদের দুজনকে সবাই চিনত না। একেবারে কম লোকই তাদেরকে দেখার সুযোগ পেয়েছিল। এলাকার প্রভাবশালী এক ভূস্বামীর ছেলেও আমাদের বিরুদ্ধ অন্য এক দলের মাঠ পর্যায়ের কর্মী ছিল। সে তার বন্ধু বান্ধবদেরকে সাথে করে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অনুষ্ঠানে এলো। ওরা ৭ জন ছিল। নিজদের সাথে অবৈধ অস্ত্রে গরম এবং কিছুটা দৃশ্যমান। রাজনীতির নষ্ট ক্ষমতার চাকচিক্যে নিজেদেরকে অজেয় ভাবা শুরু করল। এলাকা ছিল নিজদের, ক্ষমতাসীন দলের নেতার ছেলে এবং পরিচিত নিজস্ব এলাকা হওয়াতে আমাদেরকে বাইরের গেস্ট ভেবে একটু দম্ভ দেখাতে চাইল। আমাদের এক ক্যাডারের সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধালো। এবং এক পর্যায়ে তার গায়ে হাত তুললো। আমাদের ছেলেটিও অপমান সহ্য করতে পারল না। তাও দুইজন কেন্দ্রীয় 'ভাই'দের সামনে? সে ও হয়তো সবল আর সক্ষম বোধ করল।

সেও প্রতি আঘাত করল । যা হবার হল। ওরা নিজেদের সাথের কাটা বন্দুক বের করল। ওদের সাথে ছিল দুটো কাটা বন্দুক এবং একটা ওয়ান শ্যুটার। ওদের নেতা ছেলেটি ওর বন্দুক তাক করে নেশার ঝোকে গুলি করে বসল। কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের ছেলেটির। মিস ফায়ার হল। এবং দুর্ভাগ্য ঐ দলের ছেলেগুলোর। মুহুর্তে ত্রিশটির অধিক শীতল নল তাদের নীলচে মৃত্যুশীতল ভাবলেশহীন চেহারা নিয়ে ওদেরকে একেবারে স্থবির করে দিলো। ওদের সবাইকে অস্ত্রের মুখে বেধে ফেলা হল। তবে এদের ভিতর তিনজনকে ভাইদের সামনে আনা হল। সাদেক ভাই আমাদের দলের সবাইকে ঐ তিনজনকে মাঝে রেখে সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এদেরকে নিয়ে কি করা যায়? অধিকাংশই বললো, এরা যেহেতু দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে ফায়ার করেছেই। গুলি মিসফায়ার না করলে তো আমাদের কেউ না কেউ মারা যেতই। তাও এদের চরম বিচার করা উচিত। যাতে দলের বিরুদ্ধে ভুলে হলেও অন্য কেউ চোখ তুলে তাকাবার সাহস না পায়। আমি যারা এই চরম মত দিচ্ছিল, প্রত্যেকের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলছিলাম। তখনো অনুভব করিনি কী হতে যাচ্ছে! এরা সবাই পাথরে খোদাই চেহারার এক একটা যন্ত্র হয়ে উঠেছিল ঐ মুহুর্তে। এরা কি মানুষ ছিল না ঐ মুহুর্তে? মানবিকতা এবং অন্য গূনগুলো কি সাময়িকভাবে লোপ পেয়েছিল তখন? ভাইকে দেখলাম জাভেদ ভাইয়ের দিকে তাকাতে। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। অদূরে মাটিতে পরে থাকা একটা ভোতা ডাবকাটা গৃহস্থালী দা দিয়ে ঐ তিনজন ছেলেকে উপস্থিত সকলের সামনে জাভেদ ভাই জবেহ করলেন। কি নৃসংশ! কি অবলীলায় ভাই কাজটি করলেন। সেদিন একদম বোবা হয়ে গেছিলাম। কিন্তু আমার নিজের করার কিছু ছিল না। বাবা-মায়ের মধ্যকার সাময়িক বিচ্ছিন্নতাকে ঠিক করার পর, নিজের ভিতর যে উদ্যম পেয়েছিলাম একটা আদর্শকে ঘিরে মানুষের জন্য কিছু করার, ঐ দিন ঐ ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আমাকে কেমন বোবা বানিয়ে দিয়েছিল। আমি মানুষের হাতে মানুষকে নির্মম ভাবে জবেহ হতে দেখলাম। ঐ ছেলেগুলো ও নেশার ঘোরে যা করতে যাচ্ছিল, ভাই সকলের সমর্থনে যে কাজটি করলেন, সেটাও কি খুব জরুরী ছিল?

অনেক ভাবলাম।

কিন্তু এর থেকে পরিত্রানের কোনো পথ ঠিক ঐ মুহুর্তে পেলাম না। আমাদের তাত্ত্বিক নেতাদের নেতৃত্বে আমাদের ছেলেরা যারা ঐ চরম সিদ্ধান্তকে বুকে লালন করে শ্রেণিহীন মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছিল, তারাও জানত বিরোধী দলে ওরাও ঐ ছেলেগুলোর যায়গায় থাকলে তাদের অবস্থাও এমনই নির্মম হত। এই ঘটনাটিকে আমার মনোজগতে যে তোলপাড় তুলেছিল তা থেকে আমি মানসিকভাবে শুধু দলটা থেকে নয়, পুরো লড়াইটা আর চিন্তাধারা থেকেই বিচ্ছিন করে দিল। অথবা, আগে থেকেই হয়ত তাদের সবার থেকে আলাদাই ছিলাম। জানতাম না। কিন্তু, জড়িয়ে গেছি অনেক বেশি। ছাড়ানো সহজ হবে না! আতংক শীতল ধারায় শরীর বেয়ে নেমে গেল। কারো টের পাওয়াই উচিত হবে না যে আমি তাদেরকে আর সমর্থন করতে পারছি না। আজ যাদের পাশবিক গোংগানী স্মৃতিকে মূহুর্তে মূহুর্তে চাবুক মারছে তাদের মত আওয়াজ আমার গলা থেকে বের করতে ভাইদের মোট আধাঘন্টাই লাগবে!

ঠান্ডা ঘামের সাথে খুবই ঠান্ডা একটা সিদ্ধান্ত সারা শরীরে হয়ে গেল। নি:শব্দে,একা খুঁজতে হবে মুক্তির পথ!

পাবো?

জানি না। চেষ্টা করতে হবেই।

জানা হল, নেতাদের তত্ত্বকে বাস্তবায়ন করতে মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মীরা হয়ে থাকে আরো এক ধরণের শোষনের হাতিয়ার। এই হাতিয়ার ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন তখন শ্রেণিহীন সমাজ কায়েমের কথা বলে এই বিপদজনক পথে ডেকে নিয়ে আসা গোপন দলীয় নেতারা- এই অনুভবে বিদীর্ণ হলাম। কষ্টের এই পর্যায়ে মন আবার একান্ত জগতে লাভলির কাছে ফিরল। তার সাথে জীবনের ছেলেমানুষ সময়ে ছেলেমানুষী প্রতিজ্ঞা দিয়ে এক হবার পর যতবার নিজেকে তার কাছ থেকে সরিয়ে এনেছি, অসময় আর দু:সময়ের মধ্যে গিয়ে পড়েছি। আর, বাবা মায়ের চেয়ে ও তাকে পেয়েছি অনেক বেশি সহজভাবে। হয়ত সেইজন্যেই বারবার তার কাছে ফিরতে হয়েছে মনের একটু স্বস্তির জন্য। একটু সহজ ভালোবাসার জন্য।

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

৯২৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

303056
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০৪:০৮
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো লিখাটি ভাইয়া।
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৮:০৪
245106
মামুন লিখেছেন : ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ আপু।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File